আমাদের বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন নতুন নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে। এসব বাড়ি ডিজাইনের জন্যে আছে স্থপতি যারা প্রতিনিয়ত এই শহর- এই নগরের প্রতিটি বাড়ি ডিজাইন করে চলেছেন। এসব বাড়ির স্থপতিদের অনেকেই ইন্টেরিয়র নিয়ে কাজ করছেন। তবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন আমাদের দেশের স্থপতিদের মূল কাজ নয়। আসলে ওনারা ইন্টেরিয়র ডিজাইন চিন্তা করে ডিজাইন করেন বটে। তবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন মূলত একজন অন্দরসজ্জা স্থপতি বা ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্টের কাজ। আর এই প্রফেশন প্রতিদিন একটু একটু করে বাংলাদেশে নিজেদের জায়গা করে চলেছে।
ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার কী?
ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার হল আর্কিটেকচারের এমন একটা ক্ষুদ্র শাখা যেখানে ইন্টেরিয়র ডিজাইন নিয়ে বিশদ ভাবে শেখানো হয়। এই কোর্স মূলত ডিপ্লোমা আর্কিটেকচার সমমানের কোর্স হলেও এখানে বিশদভাবে আর্কিটেকচারের বিভিন্ন শাখা নিয়ে পড়াশোনা করানো হয় যেন একজন ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট একটি ইন্টেরিয়র স্পেস সুন্দরভাবে ডিজাইন করতে পারে। ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার মূলত চার বছরের কোর্স। এই কোর্স করলে যেকোন মানুষ ইন্টেরিয়র ডিজাইন কে প্রফেশন হিসেবে নিতে পারে। যদিও ইন্টেরিয়র ডিজাইনের জন্যে কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন তেমন নেই।
ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার এর জন্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন নেই?
আসলে একটি ইন্টেরিয়র ডিজাইন করার জন্যে সত্যিকারের কোন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার প্রয়োজন হয় না। মানুষ যে সময় থেকে বিভিন্ন স্থানে নিজের বাসস্থান তৈরি করছে। আজকে থেকে ৫০০ বছর আগেও যেখানে আর্কিটেকচার শব্দটার কোন অস্তিত্ব ছিলোনা- সেখানে আমরা ৫০০০ বছর আগেকার স্থাপনা ও এর মধ্যেকার অন্দরসজ্জা দেখে অবাক হয়ে যাই। এসব বিবেচনায় তো বলাই যায় যে – আসলেই স্থাপনার অন্দরসজ্জা বা ইন্টেরিয়র ডিজাইন করতে প্রয়োজন শুধুমাত্র রুচিবোধের। এছাড়া আর বিশেষ কিছুর তেমন প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ বর্তমান বাজারে একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার যিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত- লোকে তাকে মূল্যায়ন করে বেশি। একারণে আমাদের সমাজে এখন ধীরে ধীরে ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্টের চাহিদা তৈরি হচ্ছে।
ক্যারিয়ার হিসেবে ইন্টেরিয়র ডিজাইনঃ
ক্যারিয়ার হিসেবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন বেশ চ্যালেঞ্জিং। এই চ্যালেঞ্জের বেশ কিছু কারণ আছে। আসুন একে একে এগুলো নিয়ে আলোচনা করি।
- বাজেট স্বল্পতাঃ আমাদের দেশেরমানুষের ইন্টেরিয়র ডিজাইনের ক্ষেত্রে বাজেট স্বল্পতা একটি মূল কারণ যার জন্যে ইন্টেরিয়র সেক্টর বেশ চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হচ্ছে প্রতিনিয়ত। দেখা যায় একটি বাড়ি তৈরিতে ও এর ফিনিশিং ম্যাটেরিয়েলস কেনার জন্যে প্রায় ৯০ভাগ টাকা খরচ হয়ে যায়। ফলে ইন্টেরিয়র ডিজাইনের জন্যে তেমন অর্থ বরাদ্ধ থাকে না। ফলে ইন্টেরিয়র ডিজাইন এ তেমন একটা প্রাধান্য দেয়া হয়না। হলেও তখন ইন্টেরিয়র ডিজাইনারদেরকে সাধারণ মানের মিস্ত্রি ও কনট্রাক্টরদের সাথে বিভিন্ন জিনিসের রেট নিয়ে প্রতিযোগিতা করতে হয়। ফলে দেখা যায় ভাল ডিজাইন করেও অনেক ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট তার কাঙ্খিত কাজটি করতে পারেন না। অথবা করতে পারলেও এর মান ঠিক রাখা সম্ভব হয়না।
- ম্যাটেরিয়েল স্বল্পতাঃ আমাদের বাজারে যেসব ম্যাটেরিয়েল পাওয়া যায়- ইন্টেরিয়র ডিজাইন মূলত সেসব ম্যাটেরিয়েল দিয়েই করতে হয়। ফলে এসব ক্ষেত্রে নতুন কিছু এক্সপেরিমেন্ট করা সম্ভব হয় না। গতানুগতিক কিছুর বদলে নতুন কিছু করতে চাইলে তখন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা সম্ভব হয়না।
- ভাল ও মানসম্মত ম্যাটেরিয়েল স্বল্পতাঃ আমাদের বাজারে যেসব ম্যাটেরিয়েল পাওয়া যায়- সেগুলো দিয়েই আমাদের ডিজাইন ফুটিয়ে তুলতে হয় বিধায় আমাদের গতানুগতিক ডিজাইন এর বাইরে যাওয়া সম্ভব হয়না। দেখা যায় যেসব এক্সক্লুসিভ ম্যাটেরিয়েলস পাওয়া যায় সেগুলো বেশ দামী বিধায় ক্লায়েন্টের বাজেট চিন্তা করে সেগুলো ব্যবহার অনেক ক্ষেত্রেই করা সম্ভব হয়না। এজন্যে আমাদের দেশের ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দের বেশ চ্যালেঞ্জের সম্মুখিন হতে হয়।
- অধিক মুনাফালোভি কনট্রাক্টরদের দৌরাত্মঃ কিছু কনট্রাক্টর আছে যারা কাজ পাওয়ার জন্যে এমন কোটেশন দেয় যে এগুলো দেখে ক্লায়েন্টের মনে হয়- এই ইন্টেরিয়র সেক্টর বেশ সহজ। এই সহজ কাজটা করতে গিয়ে ওনারা শেষ পর্যন্ত নিজেরাই ক্ষতির সম্মুখিন হন। কিন্তু দিনশেষে একজন ইন্টেরিয়র আর্কিটেন্ট যিনি নিজের মেধা খাটিয়ে ডিজাইনটি করেছেন তিনি কাজটি করতে পারেন না। সামান্য কিছু টাকা বাঁচাতে গিয়ে মানহীন কাজ হয় যা ইন্টেরিয়র সেক্টরের দুর্নাম ডেকে আনে।
- ইন্টেরিয়র ডিজাইন সম্পর্কে ক্লায়েন্টের পরিষ্কার ধারণা না থাকাঃ একজন ক্লায়েন্ট যিনি ইন্টেরিয়র ডিজাইন মানেই কেবিনেট তৈরি বোঝেন- তিনি আসলে ইন্টেরিয়র ডিজাইন ব্যাপারটাই বোঝেন না। তিনি ভাবেন কয়েকটা বোর্ড দিয়ে কেবিনেট তৈরি করলেই ইন্টেরিয়র ডিজাইন করা হয়ে যায়। আর এভাবেই তিনি কাজের মানের ক্ষতি করেন। অনেক সময় দেখা যায়- একজন ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট বা ডিজাইনারের কাছ থেকে ডিজাইন নিয়ে তিনি বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে দাম যাচাই করে একটা প্রজেক্টে কয়েকজন কন্ট্রাক্টরকে কাজ দেন। যার দাম যেটায় কম- সেটা তাকে দিয়েই করতে দেন। ফলে কাজের বারোটা বেজে যায়। তিনি নিজেও বুঝতে পারেন না যে আখেরে তিনি নিজের টাকার নয়ছয় করেছেন। আবার অনেক ক্লায়েন্ট তো দেখে দেখে কম রেট দেয়া কাজগুলো করিয়ে নেন। এভাবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন মাঠে মারা যায়। একজন ফার্নিচার ডিজাইনার ও ইন্টেরিয়র ডিজাইনার যে আলাদা- এই শিক্ষাটা যেসব ক্লায়েন্টের মধ্যে থাকেনা- তাদের জন্যেই এই ইন্টেরিয়র সেক্টর প্রতিনিয়ত ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছে।
- ডিজাইনার যখন কনট্রাক্টরঃ একজন ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট যখন নিজেই পুরো কাজটির দায়িত্ব নেন- তখনই বাজে গণ্ডগোল। ইন্টেরিয়র ডিজাইনারকে তখন টাকা বাঁচাতে মানহীন পণ্যের দিকে ঝুঁকতে হয়। আর এভাবে একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনারকে লোভ পেয়ে বসে। তিনি নিজের ডিজাইনকে ঠিক রাখেন বটে- কিন্তু মানহীন ম্যাটেরিয়েল দিয়ে নিজের কাজের মান কমিয়ে নিজের ক্ষতি করে বসেন। এজন্যে একজন ডিজাইনার যখন কনসাল্টেন্সি বাদ দিয়ে নিজেই কনট্রাক্টর হয়ে যান- তখন কাজের মানের ক্ষতি বই লাভ কিছু হয়না।
ইন্টেরিয়র ডিজাইনারকে আসলে কী করতে হবে?
একজন ইন্টেরিয়র ডিজাইনারকে সঠিক পথ খুঁজে বের করতে হবে। ওনাকে কখনোই একজন কনট্রাক্টর হয়ে গেলে চলবে না। তিনি যে একজন ডিজাইনার সেটা ওনার মনে রাখতে হবে। আর এজন্যে কাজ করাতে হবে একজন কাজ জানা কনট্রাক্টরকে দিয়ে- যিনি কাজের মান ধরে রাখবেন।এক্ষেত্রে কাজের মান ঠিক রাখতে ইন্টেরিয়র ডিজাইনার সর্বোচ্চ মান যাচাই করতে পারেন- কিন্তু তিনি কোন ম্যাটেরিয়েল নিজে কিনবেন না। যা কেনার – সব ক্লায়েন্ট কিনবেন। আর এভাবেই সঠিক ইন্টেরিয়র ডিজাইন প্র্যাক্টিস চালু হতে পারে।
প্রফেশন হিসেবে ইন্টেরিয়র ডিজাইনঃ
প্রফেশন হিসেবে ইন্টেরিয়র ডিজাইন নেয়ার আগে ভাবতে হবে অনেক কিছু। এই পেশায় ক্লায়েন্টের পেমেন্ট দেয়ার কোন গ্যারেন্টি নেই। অনেক ক্ষেত্রেই ক্লায়েন্ট শেষ ধাপের পেমেন্ট না দেয়ার চেষ্টা করেন – যেটা থেকে রেহাই পেতে ডিজাইনারকে অনেক রকম কসরত করতে হয়। অনেকেই আগেই পেমেন্ট নিয়ে কাজ করেন। এটা বেশ ভাল পরিকল্পনা। যদিও এটা অনেক সময় কাজ দেয় না। অনেক ক্লায়েন্ট ডিজাইন অনলাইনে চেয়ে থাকেন।সেটা দিলেই তিনি ডিজাইন নিয়ে হাওয়া হয়ে যান। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই টাকা আদায় করার কোন বৈধ উপায় নেই। এজন্যে ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার পেশায় এসে অনেকেই বিরক্ত হয়ে এই পেশা ত্যাগ করেন। দিন শেষে টাকা যেখানে একজন ডিজাইনার এর বেঁচে থাকার মূল উপজীব্য সেখানে সত্যিই এসব অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতে দেখা প্রতিদিনকার ব্যাপার। এজন্যে প্রফেশনাল হতে হবে। আগেই ডিজাইন ফি নিয়ে নিলে অনেকেই ফ্রিতে ডিজাইন পাওয়ার চিন্তা করবে না। অনেকেই আছে যারা টাকা ছাড়া ডিজাইন দেন না বলে মার্কেটে শোনা যায়। আসলে তারাই সত্যিকারের বুদ্ধিমান- যিনি নিজের ডিজাইনকে মূল্যবান করতে পেরেছেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইন্টেরিয়র ডিজাইন বেশ শ্রমসাধ্য ও চ্যালেঞ্জিং হলেও এই খাতে প্রতিবছর লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে। দেশ বিদেশ থেকে হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে প্রতিনিয়ত শ্রমবাজার। কাঠ মিস্ত্রি- থেকে শুরু করে লেকার মিস্ত্রি- অথবা রং মিস্ত্রিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। তৈরি হচ্ছে নিত্য নতুন শ্রমবাজার যেটার মাধ্যমে দেশের অনেক কর্মহীন শ্রমশক্তির কাজের সংস্থান হচ্ছে। এই সেক্টরের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এবং তাদের লক্ষ লক্ষ পরিবার। তাই এই পেশা দেশের বাজারে এই মুহুর্তে ট্রেন্ডিং। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একটু কঠিন হলেও আশা করা যায় দিনে দিনে এই পেশায় আর ও স্বচ্ছতা আসবে। আসবে শ্রমের সঠিক মূল্যায়ন এবং অর্থের নিশ্চয়তা। এই হোক আগামীর বাংলাদেশের সকল ইন্টেরিয়র ডিজাইনার দের কামনা।
i want to learn
[…] the building has a nice style and the interior spaces are welcoming and comfy, the architect most likely did a good job creating the structure. […]